Powered By Blogger

Saturday 1 January 2022

 

ভূমি ব্যবস্থাপনা কাঠামোয় অর্পিত সম্পত্তিঃ লাভ-ক্ষতির হিসেবনিকেশ

(সুমন চৌধুরী বিকু)

------------------------------------------------------------------

বৃটিশ শাসনামল শেষে ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত হবার পর জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ত্ব আইন' ১৯৫০ প্রবর্তন পরবর্তীতে জমিদারি প্রথা বিলোপের মধ্য দিয়ে ভূমিতে প্রজার অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার  পাশাপাশি ভূমি ব্যবস্থাপনায় যে আমুল পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল সেটা প্রথম হোঁচট খায় ১৯৬৫ সালে শত্র সম্পত্তি আইন জারীর মধ্য দিয়ে সেই থেকে ১৯৮৪ সন পর্যন্ত এই আইনের মারপ্যাঁচে একটা সম্প্রদায় তথা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবার পাশাপাশি নানা আইনি ও দাপ্তরিকভাবে সেবাগ্রহণজনিত জটিলতায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজন ও পরোক্ষভাবে কমবেশী ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও বলা যায় হয়রানির শিকার হয়েছেনতবে সে বিষয়টি এ লেখার প্রতিপাদ্য নয়, কেননা এখানে শুধুমাত্র ব্যবস্থাপনাজনিত বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করা হয়েছে। 

মূলতঃ যে উদ্দেশ্যে শত্রু সম্পত্তি আইন প্রণীত হয়েছিল,পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইনের অধীনে প্রণীত পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধি,১৯৬৫ এর ১৮২ বিধি মোতাবেক তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান এলাকার যে সকল নাগরিক ৬ই সেপ্টেম্বর, ১৯৬৫ তারিখে ভারতে অবস্থানরত ছিলেন বা ঐ তারিখ থেকে ১৬ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯ (জরুরী অবস্থা প্রত্যাহারের তারিখ) পর্যন্ত ভারতে গমন করেছেন তাদের যাবতীয় সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি বলে গণ্য করা হয় এবং তার ব্যবস্থাপনা উপ-তত্বাবধায়কের উপর ন্যস্ত করা হয় জরুরী অবস্থা প্রত্যাহারের পর The Enemy property ( continuance of emergency provisions) ordinance,1969 এর বিধান অনুসারে শত্রু সম্পত্তি সম্পর্কিত বিধানসমূহ বলবত রাখা হয় পরবর্তীতে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার প্রেক্ষিতে এ অধ্যাদেশ বাতিল করে The Enemy property ( continuance of emergency provisions) (Repeal) Act,1974 জারী করা হয় এ আইনের ৩ ধারা মোতাবেক যে সব শত্রু সম্পত্তি তত্বাবধায়ক/উপ-তত্বাবধায়কের উপর ন্যস্ত করা হয়েছিল সে সম্পত্তি সম্পূর্ণভাবে সরকারে বর্তায় এবং এরপর থেকে সাবেক শত্রু সম্পত্তি সরকারে অর্পিত সম্পত্তি বলে গণ্য হয় এবং একই সাথে The vested and non-resident property (administration) act,1974 এর বিধান মোতাবেক যে ব্যক্তি বাংলাদেশের নাগরিক নন বা নাগরিকত্ব হারিয়েছেন অথবা বিদেশী নাগরিকত্ব অর্জন করেছেন তার সম্পত্তি অনাবাসিক সম্পত্তি হিসেবে সরকারে বর্তায় এই আইন প্রবর্তনের অব্যবহিত পরে ভূমি  ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত কর্মচারিগণ মাঠপর্যায়ে শত্রু সম্পত্তির সেনসাস তালিকা প্রস্তুতের কাজ শুরু করে নানাপর্যায়ে পরিচালিত ইতোপূর্বেকার বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে যে, এ কাজে নিয়োজিতদের মধ্যে অধিকাংশেরই অনৈতিকতা,সদিচ্ছার অভাব,অদক্ষতা,অবহেলা ইত্যকার নানাকারণে প্রণীত এ তালিকায় প্রচুর অনিয়ম ও অসঙ্গতি ছিল সেক্ষেত্রে অন্তর্নিহিত আরো যে কারণ ছিল, যেটা তেমন করে কোন গবেষণায় উঠে এসেছে বলে খুব একটা দেখা যায়নি; সে বিষয়ে আলোকপাত করলে যেটি উঠে আসে,জমিদারী অধিগ্রহণ পরবর্তী সময়ে "জমি যার রেকর্ড তার" এ নীতির ভিত্তিতে যখন নতুন একটি রেকর্ড প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল তখন সরকারের পক্ষ থেকে জরুরি ভিত্তিতে হস্তলিখিত একটি রেকর্ড প্রস্তুতের উদ্যোগ নেয়া হয়, যেটি এস এ রেকর্ড (স্টেট একুইজিশন রেকর্ড) হিসেবে পরিচিত তবে প্রচলিত অর্থে অনেকে এটাকে পিএস রেকর্ড (পাকিস্তান সার্ভে) হিসেবেও বলে থাকে সাধারণতঃ মাঠপর্যায়ে সরেজমিনে জরিপ বিজ্ঞানের প্রয়োগিক ভিত্তিতে যে ভূমি জরিপ করা হয়ে থাকে এটি সেরকম কোন জরিপ কার্যক্রম ছিলনা মূলতঃ কর নির্ধারণের জন্য প্রজার মালিকানার বিবরণ সম্বলিত হস্তলিখিত এ রেকর্ডটি প্রস্তুত করা হয়েছিল পূর্ববর্তী আর এস (রিভিশনাল সার্ভে) রেকর্ডের অনুকরণে এ কারণে এই স্বত্বলিপিতে পরিবর্তিত কোন দাগ নম্বরের বদলে আর এস রেকর্ডের দাগগুলোই প্রতিস্থাপিত হয় আসল যে কথাটি বলতে চাওয়া,ওই রেকর্ডে প্রস্তুতকৃত বেশীরভাগ খতিয়ানে মালিকানার বিপরীতে সুনির্দিষ্ট হিস্যা যেমন লেখা ছিলনা তেমনি একেক জায়গায় একেক ব্যক্তি দ্বারা লেখার ফলে বেশীরভাগ হাতের লেখাই ছিল দুর্বোধ্য উপরোক্ত কারণে শত্রু সম্পত্তি তালিকা প্রস্তুতকালে নানা অনিয়মের পাশাপাশি এস এ রেকর্ডের ভিত্তিতে তালিকা প্রস্তুতের ফলে সঠিক তালিকা প্রণয়নে যথার্থতা শতভাগ ছিলনা এতে যেসব অসঙ্গতিসমূহ উল্লেখযোগ্য তন্মধ্যে দেশত্যাগকারী মালিকের নাম থাকলেও তার মালিকানার পরিমাণ যথাযথভাবে নির্ধারণ করা হয়নি একটি খতিয়ানভূক্ত প্রতিটি দাগের বিপরীতে কি পরিমাণ জমি শত্রু সম্পত্তির আওতাভূক্ত তা সুনির্দিষ্টভাবে লিপি না করে সমস্ত দাগের অংশবিশেষ হিসেবে মোট পরিমাণ লেখা হয় দেশত্যাগকারীগণের স্থলাভিষিক্ত এ দেশে বসবাসকারী ওয়ারিশ, ক্রমওয়ারিশ কিংবা সহ-অংশীদারদের নাম  এবং অনেক ক্ষেত্রে অবৈধ দখলদারদের নাম যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ হয়নি ফলতঃ সরকার যে উদ্দেশ্যে এই আইন করেছিলেন অর্থাত দেশত্যাগকারীদের সম্পত্তি সরকারের দখল নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার যে উদ্দেশ্য এতে নিহিত ছিল তার সিকিভাগ ও বলতে গেলে সহল হয়নি বরং সম্পত্তিলোভী প্রভাবশালী কুচক্রীমহল এতে লাভবান হয়েছিল পরিসংখ্যান অনুযায়ী তালিকা প্রণয়ন শুরুর পর থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত সময়ে মোট শত্রু সম্পত্তির এক- তৃতীয়াংশ সম্পত্তিও সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি ২০০১ পূর্ববর্তী সময়ে এ তথ্যের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও ২০০১ সনে প্রবর্তিত "অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন" অনুযায়ি যখন '' তপশীলভূক্ত ও '' তপশীলভূক্ত সম্পত্তির তালিকা চুড়ান্ত গেজেট আকারে প্রকাশিত হয় তখনই মূলতঃ প্রকৃত চিত্রটি উঠে আসে কি পরিমাণ সম্পত্তি সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং কি পরিমাণ ছিলনা আইন অনুযায়ী এ দুই ক্যাটাগরির মধ্যে '' তপশীলভূক্ত সম্পত্তি হচ্ছে সেসব সম্পত্তি যেগুলো ইতোপূর্বে সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রণে নিয়ে একসনা লীজ নথির মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তিকে একসনা লীজ দিয়েছিল সেসব সম্পত্তি এবং এর বাইরে বাকি যেসব সম্পত্তি ছিল সেগুলো '' তপশীলভূক্ত করা হয় ভূমি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে থাকা তথ্য থেকে জানা যায়,প্রকাশিত গেজেট অনুযায়ী সারাদেশে '' তপশীলভূক্ত মোট জমির পরিমাণ    একর এবং '' তপশীলভূক্ত মোট জমির পরিমাণ     একর নানা তথ্য সূত্রে যেটি উঠেএসেছে,সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন '' তপশীলভূক্ত জমির পরিমাণের ক্ষেত্রে ও কিছু অসঙ্গতি রয়ে গেছে তার কারণ হিসেবে যেটি জানা যায়, মূলতঃ এ তালিকাটি প্রস্তুত করা হয়েছিল সারাদেশের উপজেলা ও ইউনিয়ন ভূমি অফিসসমূহে রক্ষিত অর্পিত সম্পত্তির লীজ নথি এবং রেজিষ্টারের তথ্যের ভিত্তিতে এক্ষেত্রে যেটি হয়েছে, কোন কোন অফিসে যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে অনেক নথি নানাকারণেই বিনষ্ট হলেও সে নথিসমূহ পরবর্তীতে পুনর্গঠন করা হয়নি এর মধ্যে অবকাঠামোগত অপ্রতুলতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বন্যা,ঝড়বৃষ্টি,অগ্নিকান্ড ইত্যাদির ফলে বিনষ্ট হওয়া, সংরক্ষণে গাফেলতি ও অবহেলা ইত্যাদি তদুপরিও নিয়ম অনুযায়ী লীজ নথি না থাকলেও যাবতীয় তথ্য রেজিষ্টারে লিপিবদ্ধ থাকার কথা অথচ খোঁজ নিলে দেখা যাবে বেশীরভাগ অফিসেই এ সংক্রান্ত কোন রেজিষ্টার সংরক্ষণ করা হয়নি এবং করলেও সেটি হালনাগাদ করা হয়নি এর পাশাপাশি লীজ ফি সংক্রান্ত দাবী ও আদায়জনিত একটি রেজিষ্টার মেনটেইন করার কথা থাকলেও সেটিও  সঠিকভাবে করা হয়নি অন্যদিকে দীর্ঘসময় ধরে অর্পিত সম্পত্তি সংক্রান্ত উদ্ভূত অনেক মামলা, যেগুলো আপিল কর্তৃপক্ষ তথা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক(রাজস্ব),জেলা প্রশাসক, বিভাগীয় কমিশনার, ভূমি আপিল বোর্ড ও ভূমি মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে এবং ক্ষেত্রবিশেষে বিভিন্ন দেওয়ানি ও ঊচ্চ আদালত কর্তৃক নথি তলবের কারণে সেসব দপ্তরে মামলা চলমান থাকায় বা মামলা নিষ্পত্তি হবার পর ও যথাসময়ে নিম্ন আদালতে ফেরত না পাঠানোর ফলে সে সমস্ত নথি ও অদ্যাবধি সেখানে রয়ে গেছে তালিকা প্রস্তুতের সময় সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে এসব নথি সংগ্রহ করে সেসবের অন্তর্ভূক্ত জমি আদৌ '' তপশীলভূক্ত গেজেটে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকে যায় পরবর্তীতে প্রথমবার তালিকায় বাদ পড়া জমি অন্তর্ভূক্ত করার সুযোগ দিয়ে পুনরায় তালিকা চাওয়া হলেও তাতে খুব উল্লেখযোগ্য পরিমাণ জমি যে অন্তর্ভূক্ত হয়নি সেটা পরবর্তিতে প্রকাশিত সংশোধনী/সম্পূরক গেজেট থেকে বুঝা যায়যাই হোক, শুরুর দিকে বলতে গেলে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে নানা পর্যায় থেকে আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়ে পৃথক দু'টি অধ্যাদেশ যথাক্রমে ১৯৭৪ ইং সনের ৪৫ নং এবং ১৯৭৬ ইং সনের ৯৩ নং অধ্যাদেশ জারীর মাধ্যমে ব্যবস্থাপনা ও পদ্ধতিগত সংস্কার সাধনের উদ্যোগ নেয়া হলেও প্রকৃতপক্ষে শত্রু সম্পত্তি (এনিমি প্রপার্টিজ) থেকে অর্পিত ও অনাবাসিক সম্পত্তি (ভেস্টেড এন্ড নন-রেসিডেন্ট প্রপার্টিজ) হিসেবে নাম পরিবর্তন ব্যতিরেকে তেমন উল্লেখযোগ্য কোন পরিবর্তন সাধিত হয়েছে বলা যায়না এমনকি স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অধীন উপ-তত্ত্বাবধায়ক এর কার্যালয়, শত্রু সম্পত্তি (জমি ও ইমারতকর্তৃক ২৬/০৬/১৯৬৮ ইং তারিখের স্মারক নং-১৬৯৪-১৩-৫০৫/৬৭-ইপি মোতাবেক জারীকৃত পত্রের নির্দেশনা মোতাবেক ভারতীয় মুসলমানদের মালিকানাধীন সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত নির্দেশনার মাধ্যমে হিন্দু-মুসলমানের স্বার্থ পৃথকভাবে সুনির্দিষ্টকরণ ও বৈষম্যের যে নিকৃষ্ট উদাহরণ তৈরি করা হয়েছিল সে বিষয়ে ও কোন পদক্ষেপই নেয়া হয়নিঅন্যদিকে পরবর্তীতে ২৬/০৭/১৯৭৫ ইং তারিখ আইন মন্ত্রণালয় কর্তৃক সার্কুলার নং- ডিএনআর ২৯/৭৫ মোতাবেক শত্রু সম্পত্তি হিসেবে নতুন কোন সম্পত্তি গ্রহণ না করার যে আদেশ জারী করা হয়েছিল সেটিও মাত্র সাত মাস সময়ের ব্যবধানে অকার্যকর হয়ে পড়েমহামান্য হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত উল্লেখক্রমে আইন মন্ত্রণালয়ের পূর্বোক্ত সার্কুলারটি অবৈধ ঘোষণা করে পুনরায় অর্পিত সম্পত্তি ঘোষণা করার সুযোগ রাখা হয়এবং তদপ্রেক্ষিতে ভূমি মন্ত্রণালয় কর্তৃক ১৭/০৪/১৯৭৬ ইং তারিখ স্মারক নং-৬৬৭(১৮)-ভিপি-১১৫/৭৬ মোতাবেক নতুনভাবে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা ও পরিচালনা সম্পর্কে নির্দেশাবলী জারী করা হয়

  সার্বিকভাবে যেটি দেখা যায়, ১৯৬৫ ইং পরবর্তী সময়ে এতদসংক্রান্ত বিষয়ে সরকারের কার্যকরী সিদ্দান্ত গ্রহণে ব্যর্থতা,পৃথক দপ্তর/অধিদপ্তর সৃষ্টির মাধ্যমে পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল নিয়োগ না দেয়া ইত্যাদি কারণে খুঁড়িয়ে চলা এ কার্যক্রমকে গতিশীল করতে ২৩/০৫/১৯৭৭ ইং তারিখ ভূমি মন্ত্রণালয় কর্তৃক নতুন করে অর্পিত সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা,প্রশাসন ও বিলি বন্দোবস্ত সংক্রান্ত বিষয়ে পুনরায় নতুন করে নির্দেশনা জারী করা হয় সে অনুযায়ী মূলতঃ ভূমি ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত তহশিলদারগণের উপর মাঠপর্যায়ে এ কাজ়ের দায়িত্ব ন্যস্ত হয়একইসাথে মাঠপর্যায়ে নতুন করে অর্পিত সম্পত্তি ঘোষণার কার্যক্রমে গতি আনতে নিয়োজিত কর্মচারীদের পুরস্কৃত করার ঘোষণা দিয়ে উদ্দীপ্ত করা হয়এতদস্বত্বেও বলা যায়,প্রকৃত অবস্থা তথৈবচঃকেননা মাঠ পর্যায়ে সরেজমিনে জমি চিহ্নিত করা, শ্রেণি বিভাজন করা, দেশত্যাগী ব্যক্তি/পরিবারের নির্ভুল তথ্য সংগ্রহ করা,অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে তাদের মালিকানা নির্ধারণ করা, এদেশে বসবাসকারী সহ-অংশীদারদের তথ্য সংগ্রহ করা, বাস্তব দখলকারদের তথ্য সংগ্রহ করার মধ্য দিয়ে নির্ভুল সেনসাস তালিকা তৈরি করা মোটেও সহজ কাজ ছিলনা ফলে ভূমি ব্যবস্থাপনার মূল দায়িত্বে নিয়োজিত তহশিলদারগণ কর্তৃক তাদের নিয়মিত কাজের পাশাপাশি নির্ভুলভাবে এই কাজটি করা বাস্তবিক অর্থেই দুরূহ ছিলএরূপ অবস্থায় সামরিক শাসক রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসার পর আইন ও ভূমি সংস্কার মন্ত্রণালয় ১৩/০৯/১৯৮২ ইং তারিখ পুনরায় অর্পিত ও পরিত্যক্ত সম্পত্তি বিলি বন্দোবস্ত সংক্রান্ত নতুন একটি নীতিমালা প্রণয়ন করেএর অব্যবহিত পরেই ভূমি প্রশাসন বোর্ডের অর্পিত সম্পত্তি বিলিবন্টন বিষয়ক আরেকটি পত্রে পূর্ববর্তী সময়ের ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি এবং দৈন্যতা স্পষ্টভাবে কর্তৃপক্ষের পর্যবেক্ষণে প্রতিভাত হয় উক্ত পত্রে বর্ণিত পর্যবেক্ষণে জমি সম্পর্কিত পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংগৃহীত এবং সংরক্ষণ করা না হলে নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে মর্মে আশংকার কথা উঠে আসে ও সারাদেশে অর্পিত সম্পত্তির দখল ও নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের তাগিদ দেয়া হয় এবং একইসাথে স্বীকার করা হয় যে,সারাদেশে মোট অর্পিত সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ সম্পত্তি ও সরকারের দখলে আসে নাইপূর্বে পেরিয়ে আসা দীর্ঘ প্রায় বিশ বছর সময়ে অর্পিত সম্পত্তি ব্যবস্থাপনার এই দৈন্যদশা এবং আগামীতে তার সুফল-কুফল,লাভ-লোকসান ইত্যাদি বিবেচনা করেই হয়তো পরবর্তীতে ০৬/০৮/১৯৮৪ ইং তারিখে বঙ্গভবন (রাষ্ট্রপতির সচিবালয়) থেকে নং-সি,এস,টি-৭২()/৮৪-৮১-() মোতাবেক নতুন করে অর্পিত সম্পত্তি হস্তান্তর এবং ঘোষণা বন্ধ মর্মে মহামান্য রাষ্ট্রপতির ঘোষণাবলী জারী করা হয়হয়তো রাষ্ট্রের কাছে এটাই অনুমিত হয়েছে যে,গত বিশবছরে যে সম্পত্তি পরিপূর্ণভাবে সরকারের দখল-নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি সেটা নিশ্চয় অদূর ভবিষ্যতেও সুদূর পরাহতইতোমধ্যে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় সূচিত পরিবর্তন তথা প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে উপজেলা পরিষদ প্রবর্তনের পর বাস্তবতার নিরিখে ভূমি মন্ত্রণালয় কর্তৃক ১৪/১২/১৯৮৯ ইং তারিখে জেলা-উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে অর্পিত সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে আরেকদফা নির্দেশনা দেয়া হয় সে অনুযায়ী ভিপি তহশিলদারগণকে ব্যবস্থাপনার মূল কাঠামোতে আত্মীকরণের মাধ্যমে নতুন করে জেলা-উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে অর্পিত সম্পত্তি ব্যবস্থাপনার মূল দায়িত্ব জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসক এবং মাঠ পর্যায়ে জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণাধীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা,সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা (তহশিলদার)গণের উপর ন্যস্ত হয় তখন থেকে প্রকৃতপক্ষে অর্পিত সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিষয় দু'টি প্রধান কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়তার একটি, যে সমস্ত সম্পত্তি ইতোপূর্বে সরকারের দখল ও নিয়ন্ত্রণে এনে লীজের আওতায় আনা হয়েছিল সে সমস্ত লীজ নথি ব্যবস্থাপনা তথা ফি বছর লীজ নবায়নের মাধ্যমে সরকারী রাজস্ব তথা লীজ ফি আদায় করা এবং দ্বিতীয়টি লীজ বহির্ভূত যে বিশাল পরিমাণ সম্পত্তি সরকারের নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত থেকে গিয়েছিল সেগুলো কাগজে-কলমে হলেও পরোক্ষভাবে সরকারের নিয়ন্ত্রণে রাখা অর্থাত সরকারী সম্পত্তি হিসেবে যথাযথভাবে রেকর্ডভূক্ত রাখা কিন্তু পূর্বের ধারাবাহিক ব্যবস্থাপনাজনিত অসঙ্গতির প্রভাব এখানেও চরমভাবে পড়তে থাকে এবং নানা উপায়ে ও প্রক্রিয়ায় আইনি দুর্বলতার ফাঁক গলে নিয়মিত সরকারের মালিকানা হ্রাস পেতে থাকে তার উল্লেখযোগ্য কারণসমূহ বিশ্লেষন করলে দেখা যায়,জরিপকালে অসংগতিপূর্ণ ও অসম্পূর্ণ তথ্য উপস্থাপনের ফলে সরকারের নামে রেকর্ডভূক্ত না হয়ে ব্যক্তির নামে রেকর্ড হওয়া, নানা জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে রেজিষ্ট্রি দলিল সম্পাদনের মাধ্যমে হস্তান্তরের ফলে ক্রমাগত বেহাত হওয়া, জরিপ পরবর্তি রেকর্ড প্রণয়নকালে কোন কোন এলাকায় অর্পিত সম্পত্তিসমূহ মৌজাওয়ারী পৃথক ১/১ নং খতিয়া্নভূক্ত করা হলেও অনেক এলাকায় ব্যক্তিমালিকানাধীন খতিয়ানে এজমালীতে রেকর্ডভূক্ত হবার সুযোগে বেহাত হওয়া,দেওয়ানি আদালতে সরকার পক্কে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকালে যথোপযুক্ত রেকর্ডপত্র উপস্থাপন করতে না পারা এবং উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে বেহাত হওয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্যদেখা যায় ভূমি মন্তণালয়ের ১৪/০১/১৯৯২ ইং তারিখের এ সংক্রান্ত এক পত্রে জরিপকালে অর্পিত সম্পত্তি হাতছাড়া হওয়ার বিষয়ে আশংকার কথাটি উঠে আসে এসব কারণে বাস্তবিক অর্থে প্রচলিত কথার মতো "মৃত ছেলে নিয়ে কান্না করা" কিংবা "গুড়ের লাভ পিঁপড়ায় খাওয়া"র মতো অবস্থায় পরবর্তী সময়ে নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত সম্পত্তিসমূহ প্রত্যর্পণের নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্য দিয়ে সর্বশেষ একটা চূড়ান্ত ব্যবস্থা পর্ক্সন্ত পৌঁছে সেটাকে সফলতায় রূপ দিতে পারায় বর্তমান সরকারকে সাধুবাদ জানাতেই হয় যার প্রাথমিক ধাপ অনুযায়ী প্রথমে ০৪/১১/১৯৯৩ ইং তারিখে মাঠ পর্যায়ে অর্পিত সম্পত্তি সেন্সাস তালিকা যাচাই সংক্রান্ত কমিটি করে দেয়া হয় পরবর্তীতে ১৯৯৯ সনে আরো বিস্তৃত আকারে কমিটি গঠনপূর্বক ব্যাপকভিত্তিতে যাচাই প্রক্রিয়া শেষে যে প্রত্যর্পণযোগ্য সম্পত্তির তালিকা করা হয় সেটিই ছিল মূলতঃ সফলতার প্রথম ভিত্তিসে সময়েই মূলতঃ মাঠ পর্যায়ে কর্মরত ভূমি ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত কর্মচারীগণের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে লীজকৃত এবং লীজবহির্ভূত সম্পত্তির পৃথক দু'টি তালিকা করা হয়এবং সেটিই  পরবর্তীতে "অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন' ২০০১" ও পরবর্তীতে "অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন (সংশোধিত)' ২০১১" অনুযায়ী "" তপশীল ও "" তপশীলভূক্ত চূড়ান্ত গেজেট হিসেবে প্রকাশিত হয়প্রথমদিকে "" তপশীলভূক্ত সম্পত্তিসমূহ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে নিষ্পত্তির সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও পরবর্তীতে "উক্ত সম্পত্তিসমূহ কখনোই অর্পিত সম্পত্তি ছিল মর্মে গণ্য হবেনা" এমন যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত দিয়ে বলতে গেলে রাষ্ট্রকে জঞ্জালমুক্ত করার পাশাপাশি দীর্ঘসময় ধরে ঘাড়ে চেপে থাকা কলঙ্কের বোঝা চিরদিনের জন্য নামানো হয়েছেআর এটি করতে গিয়ে বর্তমান সরকারকে নিসন্দেহে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে,ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর নানা জটিলতার আবর্তে জড়ানো আইনি ধাপ পেরিয়ে সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছতে হয়েছে,তার জন্য বলতে গেলে সরকার তথা তদসংশ্লিষ্ট ভূমি মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টজনদের শুধুমাত্র ধন্যবাদ দেয়া নেহায়েতই কম হবে সর্বশেষ যেটা বলতে হয়,দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে রাষ্ট্রের ঘাড়ে চেপে থাকা এ জঞ্জালের বোঝা টানতে গিয়ে না রাষ্ট্রের লাভ হয়েছে, না সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের লাভ হয়েছে; বরং লাভ হয়েছে মধ্যবর্তী একটি সুবিধাভোগী শ্রেণির

[ তথ্যসূত্রঃ ** ভূমি প্রশাসন ম্যানুয়েল, ২য় খন্ড, ভূমি মন্ত্রণালয়,গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

** ভূমি ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়েল, ১৯৯০, ভূমি মন্ত্রণালয়,গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

** www.minland.gov.bd ]

------------------------------------------------------------------------------------------------

লেখকঃ প্রাবন্ধিক ও গীতিকার, বাংলাদেশ বেতার

-মেইলঃ scbikuland@gmail.com


No comments:

Post a Comment

LAND MANAGEMENT

  The government's land acquisition activities and the subtle inconsistencies that remain deep (Suman Chowdhury Biku) --------------...