ভূমি
উন্নয়ন কর,সরকারের রাজস্ব আয়ে হতে পারতো আরো অনেক বেশি সহায়ক
(সুমন চৌধুরী বিকু)
-----------------------------------------------------------------------------------------------
এই বাংলায় প্রাচীন ও মধ্যযুগ থেকে শুরু করে ব্রিটিশ শাসনামল পর্যন্ত সাম্রাজ্য এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আয়ের মূল খাত ছিল ভূমি রাজস্ব।১৭৯৩ সনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা চালুর মধ্যে দিয়ে জমিদার ও রায়ত এ দু'টি শ্রেণির মধ্যকার আকাশসম বৈষম্য বঞ্চনা শোষণ ও নিপীড়নের হাহাকারপূর্ণ এ বাস্তবতা ১৯৫০ সনে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত চলে আসলে ও বলা যায় ভূমি রাজস্বের এক জৌলুসময় সংস্কৃতি আবহমান এ বাংলায় যুগ যুগ ধরে চলে এসেছে।ইতিহাস ও লোকমুখে শুনে আসা গল্পগাঁথা থেকে আমরা জানতে পারি চৈত্র শেষে জমিদার বাড়িতে রাজ পূণ্যাহ,নানা উপঢৌকন নিয়ে জমিদার বাড়িতে আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজনে প্রজাদের বরণ, মুড়ি-মুড়কি বাতাসা- মিষ্টি খাওয়ার ধূম ইত্যাদি নানান কাহিনী।কিন্ত কালের বিবর্তনে এই আধূনিক যুগে রাষ্ট্রের কাঠামোগত ব্যাপক পরিবর্তনের সাথে সাথে ভূমি রাজস্বের গুরুত্ব ক্রমেই লোপ পেয়েছে।তবুও রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় অদ্যাবধি ধুঁকে ধুঁকে চলে আসছে।মূলতঃ সরকারের রাজস্ব আয়ের নানাবিধ খাত- উপখাত সৃষ্টির ফলে ভূমি রাজস্বের খাতটি ক্রমেই গৌণ হয়ে পড়েছে।তদুপরিও আশার কথা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকার তথা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নানাবিধ উপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণের মধ্য দিয়ে এ খাতটি আবারো সগৌরবে দৃশ্যমান অবস্থায় আসছে বলা যায়।
তথ্য মতে সদ্যসমাপ্ত ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ভূমি মন্ত্রণালয় ট্যাক্স রেভিনিউ ও নন-ট্যাক্স রেভিনিউ হিসেবে মোট ১৬৩২,০৮,০৮,৫২৩/- টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছে।তারমধ্যে ভূমি উন্নয়ন কর ৮৩২,২৩,৭০,০১৮/- টাকা; যা মোট রাজস্ব আয়ের ৫১%।এছাড়া সায়রাত মহাল থেকে আহরিত ৭৭৯,৮৬,৮৮,৪৮৭/- টাকা এবং অর্পিত সম্পত্তির লীজ মানি বাবদ প্রাপ্ত ১৯,৯৭,৫০,০১৮/ টাকা।সরকার ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষি জমির ভূমি উন্নয়ন কর মওকুফ করায় বর্তমানে ২৫ বিঘার উর্ধ্ব পরিমাণ কৃষি জমি এবং অন্যান্য খাত তথা শিল্প-বাণিজ্যিক ও আবাসিক খাতে ব্যবহৃত জমি থেকে ভূমি উন্নয়ন কর আদায় করা হয়ে থাকে।মূলতঃ জরিপের ভিত্তিতে প্রকাশিত রেকর্ডে বর্ণিত জমির শ্রেণি অনুযায়ী কর নির্ধারণ করা হয়ে থাকলেও যেহেতু প্রতিদিনই বলতে গেলে জমির বাস্তব শ্রেণি পরিবর্তিত হচ্ছে সেজন্য সরকার কর্তৃক জমির ব্যবহারের ভিত্তিতে কর নির্ধারণের বিধান চালু রাখা হয়েছে।কিন্তু বাস্তব অবস্থায় দেখা যায় প্রতিনিয়ত জমির শ্রেণি পরিবর্তনের ফলে যে পরিমাণ করের দাবি বৃদ্ধি পাবার কথা ছিল সে পরিমাণ বাড়ছেনা।
বিভিন্ন
গবেষণা প্রতিবেদন এবং তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে বিস্তর ফারাকের বিষয়টি দৃশ্যমান হয়ে উঠে।তথ্য মতে বাংলাদেশে মোট
ভূমির পরিমাণ ৩,৫৭,৬৩,০০০ একর। তন্মধ্যে কৃষি জমির পরিমাণ
২,০৪,৮৪,৫৬১ একর।এবং কৃষি জমি থেকে সারাদেশে
প্রতিদিন গড়ে ৫৪৩ একর জমি অকৃষি জমিতে রূপান্তরিত হচ্ছে; যা বছর শেষে দাঁড়ায়
২,০২,৫৪০ একর।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ডঃ আবুল বারাকাতের এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ১৯৭২ - ২০০৯ সন পর্যন্ত সময়ে কৃষি জমি থেকে অকৃষি জমিতে রুপান্তরিত হওয়া জমির মধ্যে ৬৪,৪৩৯ একর জমি ঘরবাড়ি, ৬২৬২ একর জমি দোকান, ২২২ একর জমি কলকারখানা, ২৮২৭ একর জমি বিদ্যালয়, ৪৯৯ একর জমি স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং ১৯৯৯ একর জমি মসজিদ হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছে।এছাড়া এর বাইরে ইটভাটা, খেলার মাঠ,বিনোদন পার্ক,অর্থনৈতিক অঞ্চল ও রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকা এবং নতুন সড়ক-মহাসড়ক ইত্যাদি শ্রেণির জমি ও থেকে যায়।উপরোক্ত হিসেব মতে দেখা যায়, অকৃষি জমিতে রূপান্তরিত হওয়া মোট জমির মধ্যে ঘরবাড়ি প্রায় ৮৫ শতাংশ, দোকান ৮ শতাংশ,কল-কারখানা ০.৩০ শতাংশ,স্বাস্থ্যকেন্দ্র ০.৬৫ শতাংশ বিদ্যালয় ৩.৭০ শতাংশ এবং মসজিদ ২.৩৫ শতাংশ।ধরে নেয়া যায় ২০০৯ পরবর্তী সময় থেকে অদ্যাবধি এ পরিমাণ কমপক্ষে তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়ে থাকবে।১৪২২ বাংলা সন থেকে অঞ্চল্ভিত্তিক প্রচলিত ভূমি উন্নয়ন করের সর্বশেষ হার পর্যালোচনায় দেখা যায়, ছয়টি ধাপের মধ্যে প্রথম চারটি ধাপে বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত প্রতিশতক জমির বিপরীতে করের গড় হার ২১৩/- টাকা, শিল্প হিসেবে ব্যবহৃত প্রতিশতক জমির বিপরীতে করের গড় হার ১২৫/- টাকা এবং আবাসিক হিসেবে ব্যবহৃত প্রতিশতক জমির বিপরীতে করের গড় হার ৪৩/- টাকা।অন্যদিকে পরের দুই ধাপে অনুরূপ করের গড় হার যথাক্রমে ৫০/ টাকা, ৩৫/- টাকা ও ১৩/- টাকা।অঞ্চলভিত্তিক অকৃষি জমিতে রূপান্তরিত জমির আনুমানিক পরিমাণ নির্ধারণে যদি এভাবে ধরে নিই অর্থাৎ প্রথম চারটি ধাপে মোট জমির দুই-পঞ্চমাংশ তাহলে জমির পরিমাণ দাঁড়ায় বাণিজ্যিক ৭,৫১৪ একর, শিল্প ২৬৬ একর এবং আবাসিক ৭৭,৩৮৭ একর।এবং তার বিপরীতে বার্ষিক করের পরিমাণ দাঁড়ায় বাণিজ্যিক ১৬,৮০,৪৮,২০০/- টাকা, শিল্প ৩৩,২৫,০০০/- টাকা ও আবাসিক ৩৩,২৭,৬৪,১০০/ টাকা।অন্যদিকে বাকি দুই ধাপে অবশিষ্ট তিন-পঞ্চমাংশ জমির পরিমাণ দাঁড়ায় বাণিজ্যিক ১১,২৭২ একর, শিল্প ৪০০ একর ও আবাসিক ১,১৬,০৮০ একর। সে হিসেবে করের পরিমাণ দাঁড়ায় বাণিজ্যিক ৫,৬৩,৬০,০০০/- টাকা, শিল্প ১৪,০০,০০০/- টাকা ও আবাসিক ১৫,০৯,০৪,০০০/- টাকা।বর্ণিত মতে ফি বছর কৃষি জমি থেকে অকৃষি জমিতে রূপান্তরিত হওয়া জমির মধ্যে বাণিজ্যিক, শিল্প ও আবাসিক খাতে একত্রে মোট করের পরিমাণ দাঁড়ায় ৭১,২৮,০১,৩০০/- টাকা।
ভূমি মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত বিগত পাঁচ বছরের বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, সাধারণ খাতে (ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি) ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে মোট দাবির পরিমাণ ছিল ৪৫৩ কোটি টাকা, ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে ৪৬৪ কোটি টাকা, ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ৪৮৫ কোটি টাকা, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ৫৩৮ কোটি টাকা এবং বিগত ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ৫৬০ কোটি টাকা। এতে দেখা যায় বছর ভিত্তিক কর বৃদ্ধির পরিমাণ যথাক্রমে ১১ কোটি, ২১ কোটি, ৫৩ কোটি ও ২২ কোটি অর্থাত গড় বৃদ্ধি প্রায় ২৭ কোটি টাকা।অথচ পরিসংখ্যান মতে পাঁচ বছরের ধারাবাহিকতায় বিগত বছরে এসে দাবির পরিমাণ দাঁড়ানোর কথা ছিল ৮০৮ কোটি টাকা।
মন্ত্রণালয়ের ২০১৩-২০১৪ সনের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ঐ বছর ট্যাক্স রেভিনিউ তথা ভূমি উন্নয়ন কর খাতে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১৭৯০ কোটি টাকা এবং তার বিপরীতে আদায় হয়েছিল মাত্র ২৬৮ কোটি টাকা।এ থেকে বুঝা যায় মাঠপর্যায়ের বাস্তবতায় প্রকৃত রাজস্ব দাবি কি পরিমাণ হতে পারে তার ধারণা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ের পূর্বে থেকেই ছিল; যা আটবছর আগের বাস্তবতায় ছিল ১৭৯০ কোটি টাকা।সে অনুপাতে বর্তমান বাস্তবতায় সে অংক কত হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়!
বিশ্বব্যাংক সহ বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বাস্তবভিত্তিক গবেষণা থেকে যেটি উঠে এসেছে, দেশে প্রতিদিন গড়ে ৫৪৩ একর জমি অকৃষি জমিতে রূপান্তরিত হচ্ছে; যা বছর শেষে দাঁড়ায় ২,০২,৫৪০ একর।এমন অবস্থায় ডঃ আবুল বারাকাতের গবেষণায় উঠে আসা তথ্য-উপাত্তের অনুপাতেউপরোক্ত তথ্যের তুলনামূলক পর্যালোচনায় অকৃষি জমিতে রুপান্তরিত হওয়া জমির শ্রেণিভিত্তিক পরিমাণ বৃদ্ধির বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রতিবছর ৮ শতাংশ হারে বাণিজ্যিক শ্রেণির জমির পরিমাণ দাঁড়ায় ১৬,২০৩ একর, শিল্প শ্রেণি ৬০৮একর ও আবাসিক শ্রেণি ১,৭২,১৫৯ একর। এবং করের গড় হার অনুযায়ী এ তিনটি খাতে করের পরিমাণ দাঁড়ায় বাণিজ্যিক খাতে ২৫,৯২,৪৮,০০০/- টাকা, শিল্প খাতে ৫৭,৭৬,০০০/- টাকা এবং আবাসিক খাতে ৫৬,৮১,২৪,৭০০/- টাকা মোট ৮৩,৩৮,৪৮,৭০০/- টাকা।এ অবস্থায় ২০১৫ ঝ্রিঃ পূর্ববর্তী সময়ের কথা বাদ দিলেও ২০১৬ খ্রিঃ সনে ধার্য্যকৃত দাবী ৪৫৩ কোটি ভিত্তি ধরে পরবর্তী ছয় বছরের ধারাবাহিক বৃদ্ধি যোগ করলে সদ্যসমাপ্ত ২০২১ সনে বাবীর পরিমাণ হবার কথা ছিল ৯৫৩ কোটি; যা বাস্তবে মাত্র ৫৬০ কোটি টাকা।
উল্লেখ্য ডঃ আবুল বারাকাতের উল্লেখিত গবেষণার সময়কাল ছিল ১৯৭২-২০০৯ খ্রিঃ সন পর্যন্ত।এ ধারাবাহিকতায় যদি দেখা হয় তবে পরবর্তী বছরসমূহে গড় বৃদ্ধি অনুযায়ী প্রকৃত টাকার অংক আরো অনেক বেশি হবার কথা; যেটি মূলতঃ ২০১৩-২০১৪ সনে মন্ত্রণালয় নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রাকেই যথার্থ হিসেবে প্রমাণিত করে।যার ধারাবাহিকতায় বর্তমানে এ অংক দাঁড়ানোর কথা প্রায় ২৫০০ কোটি টাকা।বাস্তবিক অর্থে সরকারের রাজস্ব আয়ের অন্যান্য খাতের তুলনায় এ খাতে অর্থাত ভূমি উন্নয়ন কর হিসেবে আহরিত রাজস্ব হয়তো তুলনামূলক বিবেচনায় অনুল্লেখ্য; তদুপরিও জমির প্রকৃত ব্যবহারভিত্তিক কর নির্ধারণ করা হলে করের এ খাত তথা ভূমি উন্নয়ন কর সরকারের রাজস্ব আয়ে নিঃসন্দেহে আরো অনেক বেশি অবদান রাখতে পারতো।
------------------------------------------------------------------------------------------------
সুমন
চৌধুরী বিকু,
গীতিকার, বাংলাদেশ বেতার।
ই-মেইলঃ scbikuland@gmail.com
No comments:
Post a Comment